সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

ঘষা কাঁচের জীবন আর দেওয়াল জুড়ে বেঁচে থাকা

এখানে চশমা খুলে প্রবেশ করুন... এই ছবিটি পেলাম আমার এক বন্ধুর কাছ থেকে। হুগলীর চুঁচুড়ার শ্যামবাবুর শ্মশানের এই ছবি। যে ছবি দেখে কী লিখবো ভাবছি আমি। একদম হাত সরছে না আর আমার। স্থানুবত হয়ে দাঁড়িয়ে থাকা যেনো আমার এই ছবি দেখে। জীবনের শেষ যাত্রাপথে অন্তিম সময়ে কেমন করে যেনো সব কিছুকে ছেড়ে মায়া আর মোহ কাটিয়ে চলে যাওয়া দূরে অনেক দূরে। পরিবার, পরিজন, আত্মীয় স্বজনের মায়া কাটিয়ে চলে যাওয়া। সন্তান এর মায়া কাটিয়ে চলে যাওয়া।

 জীবন নামক একটি বৃহৎ পরিসরে একবুক ভালোবাসার মায়া কাটিয়ে চলে যাওয়া। বেঁচে থাকার মধ্যে জড়িয়ে ছিল কত সুখ দুঃখের ভালবাসার আর ভালোলাগার অনুভূতি। সেই অনুভূতির অনুরণনকে বুকের মাঝে চেপে রেখে চলে যাওয়া। আর সেই চলে যাওয়ার যাত্রাপথে দাঁড়িয়ে থাকা নিকট জনের। দু চোখের সেই এক সময়ের দৃষ্টি দান করা ঘষা কাঁচের চশমা রেখে যাওয়ার নির্দিষ্ট একটি স্থান নির্বাচন করে দেওয়া এই শ্মশানে। সত্যিই অসাধারণ এই জীবন আর জীবনের শেষ প্রান্তে পৌঁছে নির্দিষ্ট স্থানে মায়াকে, ভালবাসার জিনিসকে আটকে রেখে ছেড়ে চলে যাওয়া। সত্যিই জীবন বড়ই মায়াময়। 

চুঁচুড়ার স্টেশন রোডের সেই সরকারী অফিসার শ্যাম বাবু যাঁর হয়তো চশমা ছাড়া দু চোখে সর্ষে ফুল দেখতেন একসময়ে তিনি। হাতড়ে হাতড়ে কোনও রকমে হাঁটা চলা করতেন তিনি নাতির হাত ধরে। সেই তিনিই কেমন অনায়াসে লাইন দিয়ে পৌঁছে গেছেন তাঁর নির্দিষ্ট ঠিকানায়। যে ঠিকানায় সুখ আর দুঃখের অনুভূতি কি সেটা হয়তো ঠিক ঠাওর করতে পারেন না আর তিনি। আর তিনিই তো নিজের সাধের সেই কলকাতার বৌ বাজার থেকে একটু সস্তায় তৈরি করা চশমাকে রেখে গেছেন এই দেওয়াল ঘেঁসে ঝুলিয়ে দিয়ে। কত রোদে জলে আর ঝড় ঝাপটা সামলে যে এই কাঁচের চশমা তাঁর সঙ্গী ছিল বছরের পর বছর সেটাই কেমন আজ হঠাৎ করেই দেওয়ালে আটকে গেল। তাকেও ছেড়ে চলে আসতে হলো অবশেষে।

সেই যে চুঁচুড়ার সদর শহরে সেই বড়বাজার এর সেই বৃদ্ধা যে বারবার তার বার্ধক্য ভাতা পেতে হাজির হয়েছে ওই হাসি মুখের নেতার দরবারে। যে নেতা সব কাজ হয়ে যাবে বলে সবাইকে আশ্বাস দেন। সেই নেতার পার্টি অফিসে জুতোর ভীড়ে নিজের জুতো হারানোর ভয় ছিল না তার কোনোদিনই। খালি পায়ে জুতো জোটে নি তার আর। মাসীমা চিন্তা কোরো না তুমি আমি ঠিক করে দেবো, দেখবে তোমার টাকা তুমি ঠিক পেয়ে যাবে এইবার। বলে তার হাতে দশ- বিশ টাকা গুঁজে দেবার নিদান দিতেন ওই নেতা। জনতার দরবারে তখন কত ভীড়। বৃদ্ধা কপালে হাত ছুঁইয়ে ফিরে আসতেন একবুক আশা আর ভরসা নিয়ে।

 না, তাঁর আর নিজের বৃদ্ধ ভাতার টাকা দেখে পৃথিবীর মায়া ছেড়ে চলে যাওয়া হয়নি তাঁর। সেই ঘষা কাঁচের চশমা পড়া অবস্থায় কেমন শুকনো মূখে তাঁর পৃথিবী ছেড়ে চলে যাওয়া একবুক চাপা কষ্ট আর অব্যক্ত যন্ত্রণা নিয়েই। সেই আলগা হয়ে যাওয়া ডাটির সেই হাই পাওয়ারের ভালবাসার চশমাকে ছেড়েই। যে চশমা দেওয়াল ধরে আজও বেঁচে আছে। কেমন নির্নিমেষ নয়নে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকা ওদের। সেই শ্যাম বাবু, বার্ধক্য ভাতা নিতে আসা সেই নাম না জানা বৃদ্ধা, যাঁরা সব কেমন করে একে অপরকে জড়িয়ে আঁকড়ে ঝুলে আছেন শ্মশানের দেওয়ালে স্থিরচিত্র হয়ে। জীবনের মায়া, মমতা, ভালোবাসা, বিরহ, প্রেম, যন্ত্রণা, সহ্য করে কেমন শুধু দেওয়াল জুড়েই বেঁচে থাকা। 

ঘষা কাঁচের জীবন আর দেওয়াল জুড়ে বেঁচে থাকা-
অভিজিৎ বসু।
তেরো মার্চ দু হাজার পঁচিশ।
ছবি সৌজন্য বন্ধু।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

ইটিভির পিনাকপাণি ঘোষ

কিছু মানুষ কত কাছে থেকেও পাশাপাশি এক জায়গায় বাস করেও একসাথে একসময় কাজ করেও যে কত দূরে রয়ে যান নিজের হাসিমুখ নিয়ে আর সেই চেনা ছন্দ নিয়ে সত্যিই বেশ ভালো মজার ব্যাপার কিন্তু এটা জীবনের মেঠো পথে। সেই ইটিভির বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে ঘুরে ঘুরে স্ট্রীট ফুডের ছবি তোলা আর নানা খবর করে খাওয়া দাওয়ার এপিসোড করে একসময়ে বিখ্যাত সাংবাদিক হয়ে যাওয়া ইটিভি নিউজে। আর আমাদের জেলায় বসে সেইসব হাঁ করে দেখা আর কেমন মনের ভেতর অস্থিরতা তৈরি হওয়া। একেই বলে কলকাতার রাজপথের সাংবাদিক বলে কথা।  সেই যে বার রাষ্ট্রপতি এলেন জয়কৃষ্ণ লাইব্রেরী প্রাঙ্গণে সেই অনুষ্ঠানের বিশেষ কার্ড জোগাড় করে দেওয়ার অনুরোধ করা ইটিভির চাকরি করার সুবাদে। কোনো রকমে সেই কার্ড জোগাড় করে এনে দেওয়া তাঁকে আর তাঁর পরিবারের সদস্যদের জন্য। আর সেই একদিন দুপুর বেলায় খুব সম্ভবত করোনা শেষ পর্বে বালিঘাট স্টেশন থেকে অফিস যাওয়ার সময় এসি পঞ্চাশ এর বাস এর ভিতরে দেখা হওয়ায় কত গল্প করা দুজন মিলে পুরনো দিনের। আবার উত্তরপাড়ার সেই বিখ্যাত চায়ের দোকানে আড্ডা দিতে গিয়ে হাসি মুখে দেখা হয়ে যাওয়া রাতের বেলায় কাঁঠালবা...

আমাদের সবার মৃনাল দা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এক বাবা আর ছেলের লড়াই এর গভীর গোপন কাহিনী। এই সাংবাদিকতার পেশায় এসে কত লড়াই, কত অসম যুদ্ধ, করে যে কেউ সংসার টিকিয়ে রাখতে পারে হাসি মুখে কাউকে কিছুই বুঝতে না দিয়ে। এমন করে কেউ টিকে থাকার চেষ্টা করেন সেটা বোধহয় আমার জানা হয়ে উঠত না কিছুতেই। যদি না এই পেশায় আমি গা ভাসাতাম এমন করে। জীবনের এই নানা টুকরো টুকরো ছবির কোলাজ ভেসে ওঠে এই রাতের অন্ধকারে আচমকা আমার মনের মাঝে। আর আমি চমকে উঠি কেমন করে তাদের সেই কোলাজ দেখে।  এমন এক চরিত্র, বহুমুখী প্রতিভার অধিকারী হয়ে কেমন আলগোছে, হাসিমুখে, নির্মোহ ভাবে, শুধু নিজের কাঁচা পাকা দাড়িতে হাত বুলিয়ে জীবনটা কাটিয়ে দিলো সে শুধুই আকাশ পানে তাকিয়ে। যে নীল আকাশের গা ঘেঁষে উড়ে যাওয়া সাদা বকের ডানায় লেগে থাকে মেঘের হালকা টুকরো। একদম যেনো সিনেমার পর্দার হিরোর মতোই। দেখে বোঝার উপায় নেই একদম। পেটে খাবার না থাকলেও মুখের হাসিটা অমলিন হয়েই বেঁচে আছে আজও এতোদিন পরেও। আর সেই বিখ্যাত সাদা পাকা নাসিরউদ্দিন স্টাইলের দাড়ি, কালো চুল, আর সব সময় ধোপদুরস্ত ফিটফাট একজন মানুষ। রাত নটা বাজলেই যাকে শ্রীরামপুরে...

শপিং মলের উদ্বোধনে সিঙ্গুর আন্দোলনের দাপুটে মন্ত্রী

নালিকুল স্টেশন বাজারে একটি শপিং মলের শুভ উদ্বোধন অনুষ্ঠানে মন্ত্রী বেচারাম মান্না হাজির। একসময় যাঁর অন্দোলনের ঠেলায় পড়ে দৌড়ে একপ্রকার পালিয়ে চলে যেতে হয়েছিল সিঙ্গুর থেকে টাটা কোম্পানিকে। যে আন্দোলনের দগদগে ঘা আর সেই স্মৃতি ধীরে ধীরে আজ প্রায় মিলিয়ে যেতে বসেছে আমাদের কাছ থেকে। আজ সেই চাষার ঘরের মানুষ না হলেও সেই কৃষক আর শ্রমিকের ন্যূনতম অধিকার নিয়ে যে আন্দোলন শুরু করে সারাটা জীবন কাটিয়ে দিলেন সেই মানুষটাকেই কেমন যেন আজ শপিং মলের উদ্বোধনে দেখে বেশ ভালই লাগলো আমার।  একদম নালিকুল স্টেশনের কাছে ঝাঁ চকচকে শপিং মল। দোকানে সাজানো জিনিস পত্র। আর সেখানেই আমাদের মাননীয় মন্ত্রী বেচারাম মান্না। একদম কেমন একটু আমার অচেনা লাগলো যেন। সেই মুড়ি খেয়ে আলুর তরকারি বা শশা খেয়ে আন্দোলন শুরু করা জমি আন্দোলন এর অন্যতম পথিকৃৎ নেতা আজ এই উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে। তাহলে টাটা কোম্পানির বিরুদ্ধে যে জমি দখল নিয়ে আন্দোলন সেই আন্দোলন এর মধ্যে ছিল জোর করে জমি অধিগ্রহণের বিরুদ্ধে আন্দোলন করা। যদিও সেখানেও সেই সময়ের শাসকদলের কর্মসংস্থানের যুক্তি।তবে এই নতুন শপিং মলের উদ্বোধনে তো আর ...

ভীড়ের মাঝে একা

জীবন জুড়ে শুধুই ভীড় আর ভীড়। নানা ধরনের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় মানুষের গন্ধে, বর্ণে , স্বাদের ভীড়ে আমি একদম একা হয়ে যেতে চাই। যে ভীড় উপচে পড়া রাস্তায় শুধুই হেমন্তের ভোরে শিশিরের ফিসফিস শব্দ, পাখির কিচির মিচির আওয়াজ,ধানসিড়ি ওই নদীটির তীর ধরে ঘুঘুর আকুল মন কেমন করা ডাক, উদাসী শালিকের ঝাঁক বেঁধে উড়ে যাওয়া ওই হেমন্তের হলুদ ধানের মাঠ এর পাশ দিয়ে, হলুদ বসন্ত বৌরীর সেই আমলকীর গাছের পাতায়,আড়ালে আবডালে বসে কেমন যেন আমায় দেখে লজ্জা পাওয়া, আর তারপর চোখ নামিয়ে হঠাৎ করেই তার উড়ে চলে যাওয়া। আর মেঘের কোল ঘেঁষে সেই সাদা বকের, বুনো হাঁসের, আর সেই পানকৌড়ির জলে ভেজা ডানা মেলে উড়ে যাওয়া আকাশ জুড়ে। সত্যিই ওরাও যে ভিড়ের মাঝেই বড়ো একা। একা একাই ওদের যে এই বেঁচে থাকা। কেমন নিপাট হৈ চৈ হুল্লোড়হীন একটা জীবন নিয়ে বেশ মজা করে, আনন্দ করে। আর সেই ভোরের আলোয় আলোকিত হয়ে রাস্তার একপাশে গুটি শুটি মেরে শুয়ে থাকা ওই সাদা কালো ভুলো নামের কুকুরের। যে অন্তত এই সব মানুষদের ভীড়ে ঠাসা রাস্তায় একটু যেনো আলাদা , একটু যেনো অন্য রকমের। একটু একা একাই যেনো ওর এই আলগোছে জীবন কাটিয়...

গৌড় প্রাঙ্গণে আনন্দবাজার

গৌরপ্রাঙ্গনে শতাব্দী প্রাচীন ঐতিহ্যের আনন্দের মেলা আনন্দবাজার। মহালয়ার ভোরবেলায় ঢাকের বাদ্যি আর সানাইয়ের মন কেমন করা সুরে মেতে উঠলো শান্তিনিকেতনের গৌড়প্রাঙ্গণ। প্রতি বছরের মতো এই বছরও যে হবে আনন্দমেলা আনন্দবাজার। হ্যাঁ সত্যিই যেনো আনন্দের এই হাটে বেচাকেনার পসরা নিয়ে একদিনের জন্য বসে পড়া মন প্রাণ খুলে হৈ হুল্লোড় করে। এই মেলা শুরু হয় 1915 সালের 15 এপ্রিল নববর্ষের দিনে। কিন্তু আগে এই মেলাকে একসময় বলা হতো বৌঠাকুরাণীর হাট। সেই সময় আশ্রমের মহিলারা নিজেদের হাতের তৈরি জিনিস নিয়ে মেলায় বসতেন। মেলার আয়োজন করতেন তারা। আনন্দ করে বেচাকেনা হতো। রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের সময় একবার গরমের ছুটির আগে এমন মেলা নাকি হয়েছিল। যার নাম ছিল আনন্দবাজার। পরে এই মেলার নামে হয়ে যায় আনন্দমেলা। সত্যিই আনন্দের এই মিলন মেলা।  প্রথমদিকে পাঠভবন ও শিক্ষাসত্রের ছেলেমেয়েদের নিয়ে এই মেলা শুরু হয়। পরে ধীরে ধীরে বিশ্বভারতীর সব বিভাগের পড়ুয়ারা এই মেলায় যোগদান করে। এই মেলার অন্যতম উদ্দেশ্য হলো ছাত্রছাত্রীদের বেচা কেনার লাভের টাকার কিছু অংশ জমা পরে বিশ্বভারতীর সেবা বিভাগে। সেখান থেকে এ...