আমার পঞ্চ কন্যার সিরিজে আর এক কন্যার নাম মন্দিরা। কখনও কখনও পাহাড়ে ঘেরা প্রকৃতির মাঝে ঘুরে বেড়াতে ভালো লাগে তার বেশ। আবার কখনও খোলা আকাশের নিচে সে ঘুরে বেড়ায় আপনমনে আর আপনছন্দে তার এলোমেলো এলেবেলে বিন্দাস জীবন নিয়ে। কখনও আবার দু হাত তুলে মোটর সাইকেল চেপে ছুটে বেড়ায় সে এদিক থেকে ওদিক কোনো নির্দিষ্ট লক্ষ্য না রেখেই। কখনও এদিক ওদিক হারিয়ে যেতে ইচ্ছা করে তার প্রকৃতির মাঝে একা একাই। মনে মনে গুনগুন করে গান গেয়ে বলে সে, 'কোথাও আমার হারিয়ে যাওয়ার নেই মানা'।
প্রাণবন্ত উচ্ছল তাজা একটি মেয়ে সে। আবার সেই রাতের বেলায় ঠাকুর দেখতে বেরিয়ে বহু পথ অতিক্রম করেও যে ক্লান্ত হয় না কিছুতেই অন্যদের মতো। রাস্তায় বসে পড়ে না একদমই সে। সবাই হেরে গেলেও সে কিছুতেই হারতে জানে না একদম। সেই ক্রিকেট খেলার মাঠে ডাকসাইটে সুন্দরী মন্দিরা বেদী নয় কিন্তু সে হলো মন্দিরা দে। মল্লারপুর এর গ্রামের মেয়ে মন্দিরা। সেই ছটফটে মেয়েটি কেমন যেন একটু থমকে দাঁড়িয়ে পড়লো একদিন। হোঁচট খেল রাস্তায় হঠাৎ করেই।
ওর নিজের জীবনের ছন্দ পতন হলো তার হঠাৎ করেই। সেই ওর হাসিখুশি দৌড়টা একটু থেমে গেলো হঠাৎ করেই। একটা বড় দুর্ঘটনা হলো ওর পায়ে। আর সেই থেকেই কেমন একটু একটু করে লড়াই করে ঘুরে দাঁড়ালো মন্দিরা ধীরে ধীরে। একটু একটু করে কেমন করে যেন নিজের হারানো শক্তি ফিরে পেল সে। তার পর তিন মাস ধরে দাঁতে দাঁত চেপে লড়াই করে সে দেখিয়ে দিল সে হারতে জানে না কিছুতেই।
ওকে দেখে আমার বেশ লোভ হয় আমিও যদি ওর মতো এমন জীবনে লড়াই করতে পারতাম আমার এই হেরে যাওয়া জীবনে। যদি জীবনের সব কিছু হারিয়ে যাওয়ার পরও কেমন করে যেন নিজেকে বদলে নিয়ে লড়াই করতে পারতাম একটু একটু করে ওর মতো। হাসি মুখে আশার আলো দেখে একটা নতুন ভোরের স্বপ্ন দেখতে পারতাম তাহলে কি ভালো যে হতো আমার। আমি যে ওর মতো কোনদিন এমন করে ঘুরে দাঁড়াতে পারবো না কিছুতেই সেটা জানি। আমি যে ওর মতো স্বপ্ন দেখতে পারবো না কিছুতেই দু চোখে। আর সেটাই যে মন্দিরার একমাত্র জীবনের মূলধন। সেটাই যে ওর একমাত্র পুঁজি। সত্যিই অসাধারণ ওর এই নিজেকে নিয়ে লড়াই করা। ওর ঘুরে দাঁড়ানোর জন্য লড়াই করা।
গ্রামের সহজ সরল একটি অতি সাধারণ মেয়ে যা পারে আমি সেটা পারিনা। সত্যিই অসাধারণ ওর এই লড়াই করা যাকে আমি কুর্ণিশ করি। সেই ওর সাথে কথা হয়েছে ওর বাড়ী একদিন যেতে হবে আমায়। সেই ওর গ্রামের বাড়ি। সেই ওর শ্বশুড়বাড়ি। সেই ওদের এলাকার বিশাল বড়ো মিষ্টি খাবার নেমতন্ন করেছে সে। সেই যে পুকুরের ধারে দু হাত তুলে ছবি তুলে আর অক্সিজেন নিয়ে হাসি মুখে বেঁচে থাকে সেই নিস্তরঙ্গ পুকুরের পানিতে মাছ ধরতে যেতে হবে একদিন।
সেই পুকুরের জলে জল ফড়িঙের খেলা করা আপনমনে। দোয়েলের আর সাদা বকের উড়ে যাওয়া দেখে মনে পড়বে সেই কবির লেখা ধানসিঁড়ির কথা। যে ধানসিঁড়ির তীরে বসে কবি জীবনানন্দ দাশ একদিন লিখেছিলেন, 'আবার আসিব ফিরে ধানসিঁড়িটির তীরে এই বাংলায়'। যে বাংলায় এমন মন্দিরা থাকে, পল্লবী থাকে, সেই মেঘের দেশের মেঘা আর সাজঘরের মৌলি থাকে আর সেই নামটাই ভুলে গেলাম যে আর একজনের, হ্যাঁ মনে পড়ে গেলো আমার সেই সৌমিলীরা থাকে। তাহলে আর কি এমন গ্রামবাংলার পঞ্চকন্যার সংসারে সত্যিই সুখের হাট।
একে অপরের থেকে দূরে সরে গিয়েও কেমন একে অপরকে জড়িয়ে আঁকড়ে স্বপ্ন দেখে ওরা। কঠিন কঠোর জীবনের স্বপ্ন। বেঁচে থাকার স্বপ্ন। যে বাঁচার স্বপ্ন যে ঘুরে দাঁড়াবার স্বপ্ন আমি আর এই বুড়ো বয়সে এসে দেখতে পারি না কিছুতেই। আর তাই বারবার এই পঞ্চকন্যার কথা মনে পড়ে যায় আমার। ভালো থেকো তুমি মন্দিরা। এইভাবেই লড়াই করে তুমি জিতে যাও। আর আমি দুর থেকে তোমার লড়াই দেখি আর মনে মনে তোমায় কুর্নিশ জানাই। এক গ্রামের মেয়ের ঘুরে দাঁড়াবার লড়াই। সেই সিনেমার দৃশ্য ফুটে ওঠা কোনির গল্প। সেই কোনি ফাইট। কোনি ফাইট। আর তুমি এগিয়ে চলেছ একা ,একদম একা গ্রামের মেঠো পথ ধরে আপনমনে আর আপনছন্দে।
পঞ্চ কন্যার আর এক কন্যা মন্দিরা - অভিজিৎ বসু।
ঊনত্রিশ মার্চ দু হাজার পঁচিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন