সময় গেলে সাধন হবে না,
জানোনা মোর খালে বিলে, থাকে না মিম জল শুকালে
সময় গেলে সাধন হবে না।
ওগো সময় গেলে সাধন হবে না।
বেশ সুন্দর গানের দু কলি গুনগুন করে গেয়ে তিনি আমায় শুনিয়ে দিলেন। নাম সঞ্জয় ঘোষ, সদগোপ ঘোষ, বাড়ী বীরভূম জেলার সিউড়ির তিলপাড়া এলাকায়। বীরভূম জেলার সদর শহরে সিউড়ির এসপি মোড়ের কাছে পিএইচ ই অফিস জন স্বাস্থ্য কারিগরি দফতরের অফিস এর সামনেই রাস্তার ওপর এই চায়ের দোকানে বসে আছেন তিনি হাসিমুখে।গলায় কণ্ঠীর মালা। হাসি মুখে চা তৈরী করছেন সেই ভোরবেলা থেকেই রাত পর্যন্ত। সারাদিন অজস্র লোকের ভীড়। তাঁর দোকানে চা খেতে আসছেন এই গরমেও দিনে, রাতে, সন্ধ্যায়। এই করেই তাঁর দিন চলে যায়।
বোলপুর থেকে আমিও ঘুরতে ঘুরতে চলে গেছি এই সদর শহরে সিউড়িতে। রাস্তার পাশে একচিলতে ছোট্টো দোকান। নিজে ভালো কীর্তন করেন তিনি এই চায়ের দোকান সামলে। কীর্তনের ডাক পড়লেই চায়ের দোকান বন্ধ করে তিনি বেরিয়ে পড়েন সাধন করতে। ছেলে ভালো ব্যঞ্জ বাজায়। দোকানে তাঁর মাথার ওপর ঝুলছে গুটখা নানা রং বেরঙর এর প্যাকেট। আর মনে মনে তিনি এই ভাবের গান গেয়ে উঠেছেন। আমি বললাম কী যে বলেন দাদা আপনি। সময় গেলে সাধন হবে না। এর মানে কী?
গ্যাসের ওপর বসানো চায়ের জন্য বড়ো ডেকচি থেকে তখন দুধ উথলে উঠছে। তাড়াতাড়ি করে গ্যাস নিভিয়ে বলেন, শুনুন দাদা কেনো এটা গাইলাম আমি জানেন একটা গল্প বলি আপনাকে। রূপ আর সনাতন এর নাম শুনেছেন তো আপনি? আমি বললাম হ্যাঁ শুনেছি। শুনুন সেই সনাতন প্রভুকে পোড়া রুটি দেন আর কিছুই দিতে পারেন না। নুন পর্যন্ত নেই তাঁর ঘরে। বলছেন প্রভু তুমি চলে যাও। কেনো কি পাও তুমি আমার কাছে। প্রভু বলছেন, না আমি তোমায় ছেড়ে দিয়ে যেতে পারবো না সনাতন। ভগবান কাঁদছেন তাঁর শিষ্য কে ছেড়ে যেতে পারবেন না আর শিষ্য কাঁদছে ভগবানকে ঠিক মতো দেখতে পারছেন না তিনি। তাঁর সেবা করতে পারছেন না।
আর তাই তো সেই গান, সময় গেলে সাধন হবে না। সত্যিই যদি সময় চলে যায় তাহলে আর সাধন হবে না। জানোনা মোর খালে বিলে, থাকে না মিম জল শুকালে। আমার খালে বিলে জল শুকিয়ে গেলে থাকে না মিম মানে মাছ জল শুকালে। মাছ কি আর জল শুকালে থাকে। সেই ভক্তির জল, সেই প্রেমের জল, সেই ভালোবাসার নদীর জল যদি শুকিয়ে যায় তাহলে কি আর মাছ জ্যান্ত থাকে? কিছুতেই নয়। এখানে মাছ তো সেই সনাতন এর ভগবান। সেই জগতের নাথ জগন্নাথ। যিনি বাহ্যিক সৌন্দর্য উপভোগ করে আন্দোলিত হননা। যিনি শুধু ভক্তিরসে জারিত হয়ে ভক্তের কাছেই থাকেন। বৈভবে নয়, ভালোবাসায় আর প্রেমে। আসলে সেটাই যে ভক্ত আর ভগবানের সম্পর্ক। একে অপরকে আঁকড়ে ধরে পরম আনন্দে বেঁচে থাকা।
সেই ভাবের এই গান গেয়ে বলে উঠলেন এই এত আয়োজন হৈ চৈ হুল্লোড় কী আর পছন্দ করেন তিনি এই ভগবান জগতের যিনি নাথ। তিনি কি এইসব চান এতো কিছুই। তিনি যে চান সনাতন এর সেই পোড়া রুটি। আর সনাতন গোস্বামীর সেই অন্তরের অন্তঃস্থল থেকে ওঠা গভীর ভালোবাসা। যেখানে ভক্তের সাথে ভগবানের একদম মেঠো সম্পর্ক। যে সম্পর্ক গড়ে উঠতে সময় লেগেছে হয়তো কিন্তু সেটা এই বৈভবের চাপে ভেঙে যায়নি কিছুতেই। আর তাই এত মন্দির নিয়ে আলোচনা, জোর উৎসব রাজ্য জুড়ে, ভক্তি, ভক্ত, জগন্নাথ এর মাঝে রাজনীতির সূক্ষ্ম মাত্রার ভূমিকম্প অনুভূত হলেও কেমন যেনো একটা গভীর গোপন ভালোবাসার জলছবি ধরা পড়লো যেনো আমার চোখে।
আর সেই কথাই কেমন হাসতে হাসতে বলে ফেললেন সেই সিউড়ির চায়ের দোকানের কীর্তনিয়া সঞ্জয় চা বানাতে বানাতে। যিনি জানেন অন্তর দিয়ে ভগবানকে ডাকতে মন্দির যেতে হয় না। শুধু দেহের ভিতরের মন্দিরের মধ্যে ভগবানকে ভক্তি, প্রেম আর অশ্রু দিয়ে ডাকলে তিনি ধরা দেন ভক্তের আকুল ডাকে। তাঁর জন্য ইতিহাস বদলে দিয়ে কোটি টাকার মন্দির প্রতিষ্ঠা নয়। মনের মন্দিরে তাঁকে প্রতিষ্ঠা করলেই হয়। সত্যিই সাদা জীবনের কালো কথায় আমার আঁকিবুঁকি ব্লগের পাতায় সেই মহাভারতের যুগের সঞ্জয় নয় কলিযুগের এক সঞ্জয় এর দেখা পেলাম আমি। যিনি আমার মতো একজন অন্ধ ধৃতরাষ্ট্রের চোখ খুলে দিলেন তিনি। ভালো থাকবেন আপনি। এই বিশ্বাস ভক্তি নিয়েই বেঁচে থাকবেন আপনি। সময় গেলে সাধন হবে না।
সিউড়ির কীর্তনীয়া সঞ্জয় - অভিজিৎ বসু।
পয়লা মে, দু হাজার পঁচিশ।
ছবি নিজের মোবাইল ক্যামেরায় তোলা।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন