সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

মধুদার স্মরণে

মাইনফিল্ড পেরিয়ে মধুদার নির্জন দ্বীপে বিদায় হয়েছে বেশ কিছু দিন আগেই। সেই নির্জন বিদায় কে স্মরণে রাখতেই আজ মধুদার স্মরণ সভা শান্তিনিকেতনের রতনপল্লীতে। আসলে যে মানুষটার সাথে আলাপ, পরিচয়, সখ্যতা, বন্ধুত্ব কি বলা যায় মনে হয় না কিন্তু ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করার সময়কাল আমার খুব কম সময়ের জন্য। তাঁর নির্জন বিদায়ে কেনো যে বারবার আমার মন খারাপ হয় কে জানে। মনের আর দোষ কি। 

এই ভোরের বেলায় হঠাৎ করেই ঘুম ভেঙে যায়। প্রহর গোনা শুরু হয় আর ক ঘন্টা পরেই সেই তাঁর নানা গুণগ্রাহী আর আপনজনদের নিয়ে হবে মধুদার স্মরণ সভা। যিনি বোধহয় চিরকাল নিভৃতে নির্জনে একাকি বেঁচে থাকার চেষ্টা করতেন। একটু কাউকে ধরা না দিয়ে আলগোছে বেঁচে থাকা সেই তাঁর মত করেই বাঁচা। যে বাঁচার মধ্য তিনি খুঁজে পেয়েছিলেন এক অনাবিল আনন্দ। কাউকে বিরক্ত বা বিব্রত নয় পরিবার, সমাজকে, বন্ধুকে কোনোও ভাবেই বিপদে ফেলে নয়। এই মাইনফিল্ড ধরে তাঁর একা একাই হাঁটা। ধীরে ধীরে তাঁর হাঁটার শেষ হলো আচমকাই হঠাৎ করেই। যা বোধহয় আমরা কেউই বুঝতে পারিনি।


সেই সাইকেল চালিয়ে যাচ্ছেন মধুদা ধীরে ধীরে কাঁধে ঝোলা নিয়ে। ক্লান্ত অবসন্ন শরীরে। একটা প্রতীক হয়ে। তাঁর চেনা মুখ, লম্বা দাড়ি , চেনা চশমার কাঁচ দিয়ে তাঁর জীবনকে দেখা যে জীবন আমার আপনার মত স্বার্থপর নয় ধান্দাবাজিতে পরিপূর্ণ নয়। যিনি বড্ড বেশী ভালো মানুষ ছিলেন আর তাই মনে হয় তিনি বলতে পারতেন আমার ছেলেটার একটা ছোট্ট গাড়ির লাইসেন্সের কাজটাও একটু সাহায্য করতে পারছিনা আমি অভিজিৎ। একটি অসহায় পিতার গলা। যিনি একসময় কলকাতা শহরে দাপিয়ে বেড়াচ্ছেন খবর করছেন, তাঁর লেখা সংবাদে তোলপাড় হচ্ছে আন্দোলিত হচ্ছে। সেই মানুষটার মুখে এমন কথা শুনে আমি একটু অবাক হলাম। তবু মধুদার স্মরণ এর ঠিক আগেই এই সব নানা কথা মনে পড়ে যায় আমার। সেই তাঁর স্ত্রী দেবযানীকে নিয়ে জায়গায় দুজনে একসাথে থাকার ইচ্ছার কথাও বলতেন আমায় বারবার। যে গভীর গোপন কথা মাঝে মাঝেই ব্যক্ত করে ফেলতেন তিনি। আর তারপরেই বলতেন এই রে নিজের কথা বলে ফেললাম কিছু মনে করো না তুমি। 

আসলে কী জানেন মধুদার ঘরানার মানুষজন যত বেশি কমে যায় আমাদের চারিপাশ থেকে তত কেমন যেনো ভয় হয় আমার। কাদের কাছে গিয়ে দাঁড়াবো আমি বা আমরা আমাদের এই যান্ত্রিক জীবন নিয়ে। যেখানে গিয়ে দু দণ্ড শান্তি পাওয়া যায়। যেখানে মধুদার অকৃপণ ভালোবাসা আর অল্পদিনের মধ্যেই আমাকে নিজের করে নেওয়া, কাছের করে নেওয়া, সেই সব কিছুই বলে ফেলা ধীরে ধীরে সেটা আর হবে না দাদা কোনওদিন। সেই নানা ঘটনার কথা, তাঁর ওলট পালট জীবনের কথা, যে জীবন নিয়ে ছিনিমিনি খেলতে বড়ো ভালোবাসতেন তিনি হাসি মুখেই। হিসেব নিকেশ করে জীবন যাপন নয়। সেই জীবনে তিনি গ্রামের প্রান্তিক মানুষদের জন্য কাজ করতে ভালোবাসতেন। যে মানুষ জন রাজনীতির ঘেরাটোপে বন্দী তাঁদেরকে তিনি বড্ড ভালোবাসতেন। আর তাই তিনি ছুটে চলে যেতেন তাঁদের কাছে সেই আদিবাসীদের গ্রামে। পড়াতে আসতেন এইসব ছোটো ছোটো ছেলে মেয়েদের কাছে। 

আজ এই ভোরের বেলায় আমার হঠাৎ করেই মধুদার জন্য বড্ড মন খারাপ করছে। সেই হাসপাতাল থেকে ফিরে এসে টেলিফোনে তাঁর সাথে অল্প একটু কথার মাঝে তাঁর বারবার হাঁফিয়ে হাঁফিয়ে বলা জানিনা আমি আর কোনদিন শান্তিনিকেতনে ফিরতে পারবো কি না। আমি বললাম ঠিক পারবেন দাদা। আগে সুস্থ হয়ে নিন আপনি। তারপর আমি আর আপনি একসাথে আবার ঘুরবো সেই চেনা পথ ধরে একসাথে চা খাবো আড্ডা দেবো। মধুদা শুনে চুপ করে গেলেন। 

আজ আমায় ছেড়ে চলে গেলেন মধুদা একাকী নির্জন পথ ধরে সেই তাঁর নিজের লেখা শব্দ 'মাইনফিল্ড' পেরিয়ে একা একাই। তাহলে তো আমি মিথ্যে প্রবোধ দিয়েছিলাম তাঁকে সেদিন। কে জানে আমি জানি না। আজ এই সকাল বেলায় আমার খুব ইচ্ছা করছে হঠাৎ করেই মাধুদাকে ফোন করতে। গল্প করতে। আড্ডা দিতে। সেই পুরোনো দিনের সাংবাদিকতার গল্প শুনতে। যে ক্ষমতার জীবনকে তিনি কত সহজেই বিদায় জানিয়ে চলে এসেছিলেন এই লালমাটির জায়গায়। যে দাপুটে জীবন আর দাপুটে সাংবাদিক হয়েই আর রবীন্দ্রনাথের জীবন দর্শনকে আঁকড়ে ধরেই তিনি বেঁচে থাকবেন আমাদের সবার কাছে। 

ভালো থাকবেন আপনি দাদা। এই নির্জন দ্বীপে একা একাই ঘুরে বেড়ান আপনি আপনার মতো করেই কেউ আর আপনাকে বিরক্ত করবে না কোনোদিন। আর আপনাকে আমিও কোনোওদিন ফোনে বিরক্ত করবো না বলবো না ছেলেদের কথা শুনে ওদের দুজনের আদেশ মেনে আপনাকে এখন চলতে হবে দাদা। যেটা বোধহয় আপনার কোনওদিন পছন্দ হতোনা।‌ আপনি চুপ করে শুনতেন কিছুই বলতেন না। আজ সত্যিই আমি বন্ধুহীন হলাম। আমার এই এলোমেলো আর এই এলেবেলে বিন্দাস জীবনে একজন সত্যিকারের বন্ধুকে হারালাম। ভালো থাকবেন আপনি দাদা। আমার প্রনাম নেবেন।

মধুদার স্মরণে - অভিজিৎ বসু।
২৪ শে মে, দু হাজার পঁচিশ।
ছবি সৌজন্য নিজের মোবাইল ক্যামেরায় তোলা।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনন্দবাজারের শ্যামল দা

সেই সাদা বাড়ীর অনেক বিখ্যাত সাংবাদিকের মধ্যে একজন শুধু জেলখানার খবর লিখেই যিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন গোটা সাংবাদিক মহলে, বাংলা সংবাদ পত্রের জগতে। সেই জেল রিপোর্টার বলেই অভিহিত হতেন তিনি মহাকরণের বারান্দায়, অলিন্দে আর রাইটার্সের কাঠের সিঁড়িতে হাসিমুখে। যে কোনোও মন্ত্রীর ঘরে হাসিমুখে যাঁর প্রবেশ ছিল অবারিত দ্বার। যিনি প্রথম জীবনে আনন্দবাজার পত্রিকায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার জেলার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। পরে জেলা থেকে সোজা কলকাতায় প্রবেশ তাঁর।  সেই একদম ফিটফাট সুন্দর, সুদর্শন,সুপুরুষ, বিয়ে না করেও দিব্যি হাসি মুখে মাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন ভাইপো আর সেই বর্ধমানের বড়শুল এর একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদের কাছে। আর শনিবার হলেই তাঁর সবাইকে থ্যাংক ইউ বলে কলকাতার সেই বিখ্যাত মেস এর জীবন ছেড়ে নিজের গ্রামের বাড়ী চলে যাওয়া তাঁর হাসি মুখে। বলতেন সবাইকে চলো সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে পুকুরের মাছ ধরে খাওয়া হবে বেশ আনন্দ হবে। আমার নিজের গ্রামের বাড়ীতে গেলে কোনোও অসুবিধা হবে না একদম।  আর নিজের শরীর ফিট রাখতে এই বয়সেও কেমন করে যে দুশো কপালভাতি করতেন তিনি কে জানে। একদম সবার যখ...

জামালপুরের প্রদীপ দা

আজ আমার সাদা জীবনের কালো কথায় বর্ধমানের জামালপুরের সেই দাপুটে ঠোঁট কাটা সাংবাদিক প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় এর কথা। সেই বিখ্যাত সুভাষ তালুকদার এর কাগজ সংবাদে মাত্র এক টাকার কাগজে কাজ করা সংবাদ পত্রিকার দাপুটে সাংবাদিক সেই প্রদীপ দা। সেই মুখ্যমন্ত্রীর সভায় বাঁশের ব্যারিকেডের এপারে দূরে দাঁড়িয়েও যে খবর করা যায় সেটা বড়ো মিডিয়ার সাংবাদিকদের হাসি মুখে দেখিয়ে দিয়ে, আর তাদের খবরের ময়দানে গোল দিয়ে শুধু খবরকে ভালোবেসে ছোটো কাগজে কাজ করে চলা সর্বদা হাসি মুখের সেই আমাদের প্রদীপ চ্যাটার্জী দা।  কোথাও কোনো অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদে মুখর হয়ে যাওয়া আর এক দৌড়ে বেরিয়ে পড়া ঝোলা কাঁধে সেই খবরের খোঁজে সেই জামালপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের সেই প্রদীপ দা। সেই বিখ্যাত পন্ডিত রবিশঙ্কর আর উদয়শঙ্কর এর আপন মাসতুত ভাই এর ছেলে সেই প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় দাদা। সেই বামদের আমলে জামালপুরের এলাকায় দাপিয়ে খবর করে ছুটে বেড়ানো সেই প্রদীপ দা। সেই তৃণমূল আমলেও একভাবেই ছুটে বেরিয়ে কাজ করা আমাদের সদা ব্যস্ত প্রদীপ দা।  সেই বাবার অসুস্থতার কারনে বড়ো সংবাদ মাধ্যমে কাজ না করেও...

আমার স্যার কাজীদা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ আমার স্যার এর কথা। যার লেখা আজ হঠাৎ চোখে পড়লো একটি কাগজে। আর স্যার এর নামটা দেখেই মনে পড়ে গেলো নানান কথা। হ্যাঁ, সেই কাজী গোলাম গাউস সিদ্দিকী। যাঁর সাথে আমার আলাপ আর দেখা হয়েছিল সেই অজিতদার ফ্রিল্যান্স ছকু খানসামা লেনের ফ্রীল্যান্স প্রেস ক্লাবের অফিসে খুব সম্ভবত। হাসিখুশি বেশ অজাতশত্রু এই মানুষটিকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল যে রিপোর্টারদের প্রভূত ক্ষমতা থাকে বোধহয়। তাই পকেটে পেন আর সেই ফোনের ছোট্টো নোটবুক দেখেই আমার মনে হয়, যে ক্ষমতার স্বাদ পাবার জন্য সেই সদ্য গ্র্যাজুয়েশন করে আমার কচি মনে সাংবাদিক হবার বাসনা জাগে সেই সময়।  কোনো প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক নয়, কোনো অফিসে মাছি মারা দশটা পাঁচটার লোয়ার ডিভিশন এর কেরানি নয়, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নয়, ল্যাবরেটরিতে টেকনিশিয়ান এর কাজ নয়, এল আই সি বা পোষ্ট অফিস এর এজেন্ট নয়, কোনো মুদি দোকানে হিসেব পত্র লেখার কাজ নয়, স্বাধীন ব্যবসা করা নয়। শুধুই সাংবাদিক হবার স্বাদ।  কাগজে সাদা কালো অক্ষরে নিজের নাম ছাপা হবে, সেই নাম দেখে বুক ফুলে যাবে, পাড়ায় প্রতিবেশীরা সহ স...

কুড়ি থালা দশ টাকা আর রসিক মুলুর জীবন

নাম মুলু হাঁসদা। বাংলা ঝাড়খণ্ড সীমানার চরিচা গ্রাম পঞ্চায়েত এর চর ইচ্ছা রঘুবরপুরের বাসিন্দা মুলু। আজ মুলুর জীবন কথা। গ্রামের নামটা ভারী অদ্ভুত। চর ইচ্ছা রঘুবরপুর। যে গ্রাম অন্য পাঁচটা গ্রামের মতই।সাদামাটা এই গ্রামে দারিদ্র্য, অপুষ্টি আর কর্মহীন জীবনের জলছবি সুস্পষ্ট। আর সেই গ্রামের মহিলারা নিজেদের সংসার রক্ষা করতে গাছের পাতাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। গাছের পাতা মুলুদের জীবনের জিয়ন কাঠি। যে জিয়ন কাঠিতে তারা ভোর হতেই পেটের টানে চলে যায় জঙ্গলে। খস খস শব্দ করে পায় হেঁটে তারা পাতা তোলে। গাছ থেকে টুপ টাপ করে ঝড়ে পড়া পাতাকে একটা একটা করে নিজের শাড়ির আঁচলে ভরে নেয়। তার পর সব পাতাকে বস্তায় ভরে ঘরে ফেরে।  ঠিক যেভাবে তারা পুকুরে নেমে শামুক গেঁড়ি আর গুগলি তোলে। যে ভাবে তাদের উদর পূর্তি হবে বলে। আর এই পাতাও যে তাদের পেট ভরায়। একটা একটা পাতাকে নিজের সন্তানের মতো আলগোছে ছুঁয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় মুলু, বলে তোরা না থাকলে কি করতাম কে জানে। মাথার ওপর শাল সেগুনের বিশাল আকারের গাছগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে আর তারা চুপ করে শোনে মুলুর কথা।  একে অপ...

শুভ মকর সংক্রান্তি

মকর মানেই নতুন জামা কাক ভোরে স্নান, রাত্রি জেগে মিঠে সুরে টুসুমণির গান। মকর মানেই পিঠে - পুলির গন্ধে ম - ম হাওয়া, ডুলুং পাড়ে টুসুর মেলায় দল বেঁধে যাওয়া। মকর মানেই মোরগ লড়াই পাহুড় জেতার সুখ, সন্ধ্যা - রাতে মাংস পিঠের স্বাদে ভরা মুখ। মকর মানেই হাতি - ঘোড়ার পুজো করম তলে, সান্ধ্য হাওয়ায় মন উদাসী দিমির দিমির বোলে। আসলে আজ এই মকর সংক্রান্তির দিন, টুসু মেলার দিন, টুসু গানে নিজেকে মাতিয়ে দেবার দিন। অজয় এর ধারে জয়দেব কেঁদুলির মেলায় ভীড়ের মাঝে নিজেকে হারিয়ে দেবার দিন। অজয় এর জলে ডুব দিয়ে স্নান করে পূণ্য অর্জনের দিন। আর নদীর ধারে মোরগ লড়াই এর দিন। আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর দিন, সুতো লাটাই হাতে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকার দিন। কেমন যেনো রাশির একটি স্থান থেকে অন্য রাশিতে স্থান পরিবর্তনের দিন। সূর্যের দেবতাকে সকালে উঠে স্নান সেরে প্রণাম জানিয়ে শক্তি সঞ্চয় এর দিন। সূর্যের উত্তর দিকে চলে যাবার দিন। ধীরে ধীরে শীতকাল চলে যাওয়ার দিন।  এই মকর সংক্রান্তি এর ইতিহাস ও ভারতীয় ঐতিহ্যের গভীর শিকড় রয়েছে। এটি কৃষি চক্র এবং ফসল কাটার মৌসুমের সাথে জড়িত। এই মকর সংক্রান্তি চ...