সকাল সকাল দেখলাম আজ প্রবীরদার জন্মদিন বলে নানা জনের শুভেচ্ছার বন্যা বইছে সমাজ মাধ্যমের রঙিন দেওয়াল জুড়ে। এই এক ভালো গ্যাঁড়াকল হয়েছে কি বলেন আপনারা। সেই মানুষটার সঙ্গে যোগাযোগ থাক বা না থাক। সম্পর্ক থাক বা না থাক। বন্ধুত্ব থাক বা না থাক। কথা হোক বা না হোক। শত্রু হোক বা মিত্র জন্মদিন দেখলেই আর সেটা জানতে পারলেই একেবারেই ঝাঁপিয়ে পড়া। একেবারে ঘাড়ের উপর লটকে পড়া। হ্যাপি বার্থডে বলে আদেখলেপনা করা। আজকাল তো এটাই এখন ট্রেন্ড। এই ট্রেন্ড ধরেই এগিয়ে চলা আমাদের বর্তমানে।
আজ থেকে পঞ্চাশ বা চল্লিশ বা নিদেনপক্ষে ত্রিশ বছর আগে এমন জন্মদিন উপলক্ষে দিন যাপনের হুল্লোড়, মাতামাতি, কেক কাটাকাটি, ফেসবুক আর টুইটারে শুভেচ্ছার বন্যা খুব কম দেখা দিত মনে হয়। আর রাজনৈতিক নেতাদের মধ্যে এমন জন্মদিন পালনের হিড়িক কম পড়তো সেই সময়। এমনকি শুধু তাই নয় মানুষের জন্মদিন ছেড়ে এখন বাড়ীর পোষ্যর জন্মদিন পালন নিয়ে জোর তৎপরতা আর ধুমধাম। এইসবের মাঝেই আমিও নিজেকে ভাসিয়ে দিয়েই হ্যাপি বার্থডে জানিয়ে দিলাম স্রোতের টানে। আর সঙ্গে সঙ্গে উত্তর পেলাম, 'আশি হতে আর পাঁচ বছর ,মনে হচ্ছে তার আগেই ফুটে যাব'
একদম সহজ কথায় সহজ উত্তর দিলেন প্রবীরদা আমায়। হ্যাঁ, আমাদের সেই গম্ভীর মুখে রাশভারী ভাব নিয়ে শ্রীরামপুরে স্টেশনের কাছে পল্লী ডাক প্রেসে বসে থাকা প্রবীর মুখোপাধ্যায়। সেই বিখ্যাত ইন্দু বাবুর ছেলে। সেই যাঁর ডাক নাম খোকন বলে আজ কাল আর কেউ ডাকে না বা ডাকার লোক নেই মনে হয় শ্রীরামপুরে। সেই প্রেসের খট খট শব্দ। সেই দুলাল আর বিজলীদির চেনা সংসার। সেই ষাট ওয়াটের হলদে বাল্ব জ্বলা পুরনো প্রেস। সেই কতজনের আনাগোনা। সিপিএম, কংগ্রেস, তৃণমূল, বিজেপি নানা ধরনের মানুষের আনাগোনা এই প্রেসে। কারণ একটাই হুগলী জেলার বিভিন্ন সংবাদপত্রের সাংবাদিকদের বসার জায়গা এটি। সে ছোটো, বড়ো, মেজো, সেজো, ন এমনকি ডেঙ ডোঙ্গলার দল হোক। এই বিশেষ শ্রেনীর সাংবাদিকদের জাত মান কুল কিছুই নেই তাদের এই নামেই ডাকা হয়। এই নামকরণ করেন বিখ্যাত সাংবাদিক ফাল্গুনী দা। যেটার মধ্য আমিও পড়তাম সেই সময় যতদিন আমি ইটিভির চাকরি পাইনি। এই টিভির কাজ জুটে যাবার পর অবশ্য আমার এই তকমা মুছে যায় এক নিমেষেই।
আজ প্রবীরদার জন্মদিনের কথা লিখতে বসে এমন নানা কথা মনে পড়ে যায় আমার। সেই দিলীপদার চায়ের দোকান। সেই এক টাকার বাসনা বিস্কুট আর একটি লাল চা খেয়ে আমার এই প্রেস খোলা, টেলিফোন বুথ খুলে বসা শীতের তীব্র সকালে গায়ে চাদর মুড়ি দিয়ে। একে একে বেলা হলে ভীড় বেড়ে যাওয়া সাংবাদিকদের। খবরের সন্ধানে ঠিক যেনো সেই সিনেমার আকালের সন্ধানের মতো। সেই দাপুটে সিপিএম নেতার পীযূষদার পান খেয়ে চুপ করে বসে থাকা, সেই অমিয়দার ডাকনাম থাকোদার যিনি সারা জীবন এক কংগ্রেস আদর্শে নিজেকে বেঁধে রাখলেন এদিক ওদিক না করেই। সেই কেষ্ট দা, স্বরাজ দা, গুন্ডা দা, সিং দা, আর সর্বোপরি আকবরদার ঠিকানা ছিল এই পল্লীডাক প্রেস।
আজ সেই প্রেসের বর্তমান মালিক, প্রথিত যশা সাংবাদিক প্রবীর মুখার্জীর জন্মদিন। যেখানে সন্ধ্যা হলেই ছুটে আসত পাঁচু আর সেই সুদীপ ঘোষ। সেই আর কে স্টুডিও। যে স্টুডিওতে জমা নেওয়া হতো অনেক দৈনিক কাগজের বিজ্ঞাপন। সেই শ্রীরামপুর সমাচারের সাধন দা। আর রেডিও সাংবাদিক সান্যাল দা। আসলে এই জেলার ছোটো চার পাতার কাগজ হলেও ক্ষমতার বৃত্তে প্রবীরদা ঘুরপাক খেয়ে ঘুরে বেড়িয়েছেন নানা ভাবেই। রাজনৈতিক ক্ষমতার অলিন্দে নানা জনের কাছে পৌঁছে গেছেন তিনি অনায়াসেই নানা সময়ে। বিধায়ক, সাংসদ এমনকি তৃণমূলের সর্বময় নেত্রীর কাছেও তাঁর ছিল অবারিত দ্বার। শুধুই এই পল্লীডাক কাগজ এর দৌলতে।
আজ তাঁর জন্মদিনের দিন আমার সাদা জীবনের কালো কথায় আমার আঁকিবুঁকি ব্লগের পাতায় আঁকাবাঁকা অক্ষরে কিছু লিখে ফেললাম আমি। সেই বাড়ী থেকে চাল এনে দেওয়া, গাছের এচোড় দিয়ে বলা মাকে দিস মা রান্না করবে। সেই কত যে সাহায্য করেছেন তিনি সেই সময়ে এই বুভুক্ষু নিচু শ্রেণীর সাংবাদিককে বাঁচিয়ে রাখতে। সেই খবরের দুনিয়ায় টিকে থাকতে ব্যবস্থা করে দিলেন পেজার এর। কিছু খবর পেলেই যেহেতু আমার টেলিফোন নেই সেটার মাধ্যমে খবর পাবো আমি। আসলে জীবনে সাদা কালো সবটা জুড়েই নিরবিচ্ছিন্ন এই জীবন। যে জীবনে সুখ এর দুঃখের অনুভূতি জড়িয়ে থাকে। সেই
পল্লীডাক কাগজে যেদিন দেখলাম আমি মার খেয়ে অফিসে নিজের দাম বাড়াই উত্তরপাড়া থানায় পুলিশের সাথে বচসার কোনো ঘটনায় লেখা বের হলো তাঁর কাগজে সেটা দেখে মনে মনে একটু কষ্ট পেলাম আমি।
আজ আর জন্মদিনের দিন থাক এইসব কথা। শুধু বলবো ভালো থাকুন দাদা। এইভাবেই ফুটে যাবার কথা না বলে আপনি সুস্থ থাকুন। আসলে জীবন তো এমন। এই বৌদির সাথে আপনার সুন্দর ছবি, সেই লাল বারন্দায় বসে চা খাওয়া আপনার, সেই চেনা টালির চাল, সেই সুন্দর ফুলের গাছের সুবাস, সেই আপনার আমার মেয়ের হাতেখড়ির দিন নন্দীমাঠের ইটিভির অফিসে চলে আসা। সেই আমার ছোট্ট মেয়ের বড়ো হয়ে যাওয়া। সেই নানা চাকরি ছেড়ে টোটো চালক বলে পাঁচ বছর জীবন কাটিয়ে দেওয়া। এসব তো আপনার সবটাই জানা।
তবু আজকে এই আপনার ফুটে যাবার কথা শুনে কেমন আবেগতাড়িত হলাম আমি। সেই পল্লীডাক প্রেস আজ নেই, গোপাল ফার্মেসী নেই। বদলে গেছে শ্রীরামপুরের শহর আর তার রাজনৈতিক আবহাওয়া আর এই এলাকার নেতাদের নানা জলছবির মত জীবন। তার মাঝে আপনি এখনো কাগজ বের করছেন। সেই চারপাতার সাদা কালো অক্ষরের কাগজ। যা দেখে বেশ ভালো লাগলো আমার শ্রীরামপুরের পুরসভায় একদিন। যে কাগজ এর সাথে জড়িয়ে আছে আমার এই দীর্ঘ সাংবাদিক জীবনের নানা অধ্যায়। নানা সাংবাদিকদের মধুর স্মৃতি জড়িয়ে আছে। আপনি যতদিন বেঁচে থাকবেন আমাদের সবার কাছে পল্লীডাক কাগজের প্রবীরদা হয়ে। আমাদের সবার বড়ো দাদার মতো। ভালো থাকুন আপনি। শুভ জন্মদিন দাদা। টোটো চালকের শুভেচ্ছা।
শুভ জন্মদিন প্রবীরদা - অভিজিৎ বসু।
২৫ মে, দু হাজার পঁচিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন