সরাসরি প্রধান সামগ্রীতে চলে যান

আমাদের সবার ক্যান্টিন বৌদি

আজ সেই পোদ্দার কোর্টের ক্যান্টিন বৌদির কথা। যাঁর রান্না খেতে ভীড় জমে যেত পোদ্দার কোর্টের ২৪ ঘণ্টার অফিসে। সেই সকাল থেকে রাত পর্যন্ত। যাঁর হাতের রান্না গরম ভাত, ডাল আর গোল গোল কড়কড়ে আলু ভাজা খেয়ে আমি অফিসে কাজ করতে শুরু করতাম নিশ্চিন্তে। সেই সকালে টিফিন আর চা থেকে শুরু করে দুপুরে নানা ভালো ভালো পদের আয়োজন করতেন তিনি। সেই বর্ষার সময় ইলিশ মাছের রকমারি পদ করে খেতে দেওয়া আমাদের ক্যান্টিন বৌদির। যদিও আমি নিরামিষ আহার করি সব সময় সারা জীবন। 

আর বিকেল হলেই গরম লুচি আর আলুর দম বা আলুর তরকারি সহযোগে টিফিন খেতে দেওয়া এক প্লেট করে। সেই এডিটর থেকে অফিসের সাধারণ কর্মী সবাই ক্যান্টিন বৌদির এই রান্না খেয়ে সাধু সাধু করতে ভুলতেন না কিন্তু কেউই। কোথা থেকে এলেন কার হাত ধরে এলেন কে জানে। কিন্তু মিডিয়ার অফিসে এমন রান্নাবান্না চলছে। টেবিলে টেবিলে গরম খাবার পৌঁছে যাচ্ছে। বেশ ভালই লাগত কিন্তু আমার সেই সময়ে। বিরাটিতে বাড়ী বা ভাড়া থাকতেন সেই সময় তিনি। সেই প্রাচীন আমলে বলাই ঠিক বোধহয় পুষ্পদির হাতের রান্না খেয়ে আর টানা নয় ঘন্টা ডিউটি করেই তো আমাদের দিন কোথা থেকে যে কেটে যেতো এই পোদ্দার কোর্টের অফিসে কে জানে। 

যা জানার আগ্রহ খুব বেশি আমার নেই তবু এই সাদা জীবনের কালো কথায় আমার আঁকিবুঁকি ব্লগের পাতায় সেই পোদ্দার কোর্টের অফিস, সেই কালামের চা, সেই ক্যান্টিন বৌদির রান্না, সেই লালবাজারের দোকান এর বিকেল হলেই চা খেতে যাওয়া, সেই মুড়ি আর চপ খাওয়া, সেই লালবাজারের সামনে ট্রাম লাইনের মিষ্টি ঘণ্টার আওয়াজ আর ধ্রুব টি হাউসের দোকানে গিয়ে লাইনে দাঁড়িয়ে পড়া ভীড়ের মাঝে হারিয়ে যাওয়া যে কত স্মৃতি আজ চাপা পড়ে গেছে। এটাই যে একটা জীবন ছিল। যে জীবনে কত যে সুখ আর দুঃখের অনুভব ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়েছিল এই মিডিয়া জীবনে। যে জীবনে কতজন এর সাথে যে আলাপ ছিল। কতজন যে খবরের দুনিয়ায় টিকে থাকবে এই আশায় কাজ করবে বলে ঘুরে বেড়াতো। সত্যিই এই সব মরীচিকার মাঝে নিজেকে হারিয়ে ফেলা।

সেই ক্যান্টিন বৌদির কথা লিখতে বসে মনে পড়ে গেলো এমন নানা কথা। যে সব কথা বলার কোনো মানেই হয়না। তবু সেই গরমে কাহিল হয়ে রান্না করে মাটিতেই শুয়ে থাকা তাঁর ছোটো ফ্যান চালিয়ে। সেই মার কাছে চলে আসা ছোটো মেয়ের। এমন কত যে ঘটনার কথা মনে পড়ে যায় আমার। কতদিন পর মিডিয়ার কাজ ছেড়ে দিয়ে চলে এসে এলোমেলো এলেবেলে বিন্দাস জীবনকে সঙ্গে নিয়ে ঘুরে বেড়াতে বেড়াতে সেই ক্যান্টিন বৌদির কথা মনে পড়ে গেলো আমার। 

সেই পোদ্দার কোর্টের অফিসে জেলা থেকে ডায়মন্ড হারবার থেকে ভরা বর্ষায় ইলিশ মাছ আসা। সেই ইলিশ দাম দিয়ে মানে ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করা সবাইকে। এক রিপোর্টারের মহিলা সাংবাদিক এর দীর্ঘক্ষণ লাইনে দাঁড়িয়ে ছয়টি বড়ো চেহারার মাছ কিনে নিয়ে বাড়ি নিয়ে যাওয়া তাঁর। আর ক্যান্টিন বৌদির রান্নার জন্য বড়ো চেহারার মাছ এর বদলে ছোটো মাছ মেলায় আমায় দোষারোপ করা। কারণ ইলিশ বিলির দায়িত্ব ছিল আমার। সেই কথাও উঠে এলো আজ আমার। সেই ওনার ছোটো মেয়ে আজ কত বড় কে জানে। ওর মেয়ের জন্মদিনে শুভেচ্ছা জানাতে গিয়ে ওকে বেশ ভালোই লাগতো আমার। পোদ্দার কোর্টের অফিস বদলে গেলো। ভেঙে গেলো ক্যান্টিন বৌদির প্রিয় ক্যান্টিন। সেক্টর ফাইভের ঝাঁ চকচকে নতুন অফিস হলো। খবরের অফিস এর স্থান বদল করা হলো। কিন্তু সেই নতুন সংসারে আর জায়গা হলো না তাঁর। 

আজ এই গভীর রাতের বেলায় মনে পড়ে যায় সেই সব জুড়ে থাকা আর জোড়া লাগা নানা মানুষের কথা। যে সব কথাই লিখে ফেলি আমি। যে কথা লেখার নয়। তবু আমার জীবনের এই জুড়ে ছড়িয়ে ছিটিয়ে পড়ে থাকা নানা কথা যে অকথিত কথাকে স্মরণ করেই বেঁচে থাকা আমার। যে বাঁচায় পোদ্দার কোর্ট নেই, ট্রাম লাইন নেই, কালাম এর চায়ের দোকান নেই, সেই আমাদের হাসি মুখের ক্যান্টিন বৌদির রান্নাঘর আজ নেই। কত দিন যে সেই গরম ভাত ডাল আর খাওয়া হয়নি আমার। সেই বিকেল হলেই কি হয়েছে আজ জানতে ছুটে যাওয়া হয়নি আমার বৌদির কাছে। সত্যিই অসাধারণ ছিল কিন্তু সেই ফেলে আসা দিনের এই গড়পড়তা মিডিয়ার অতি সাধারণ জীবন। আজ সেই কথা আর পুষ্প বৌদির কথা লিখে ফেললাম আমি।

আমাদের সবার ক্যান্টিন বৌদি - অভিজিৎ বসু।
দশ জুন, দু হাজার পঁচিশ।
ছবি সৌজন্য ফেসবুক।

মন্তব্যসমূহ

এই ব্লগটি থেকে জনপ্রিয় পোস্টগুলি

আনন্দবাজারের শ্যামল দা

সেই সাদা বাড়ীর অনেক বিখ্যাত সাংবাদিকের মধ্যে একজন শুধু জেলখানার খবর লিখেই যিনি বিখ্যাত হয়ে গেলেন গোটা সাংবাদিক মহলে, বাংলা সংবাদ পত্রের জগতে। সেই জেল রিপোর্টার বলেই অভিহিত হতেন তিনি মহাকরণের বারান্দায়, অলিন্দে আর রাইটার্সের কাঠের সিঁড়িতে হাসিমুখে। যে কোনোও মন্ত্রীর ঘরে হাসিমুখে যাঁর প্রবেশ ছিল অবারিত দ্বার। যিনি প্রথম জীবনে আনন্দবাজার পত্রিকায় দক্ষিণ ২৪ পরগণার জেলার রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেছেন। পরে জেলা থেকে সোজা কলকাতায় প্রবেশ তাঁর।  সেই একদম ফিটফাট সুন্দর, সুদর্শন,সুপুরুষ, বিয়ে না করেও দিব্যি হাসি মুখে মাকে নিয়ে জীবন কাটিয়ে দিলেন ভাইপো আর সেই বর্ধমানের বড়শুল এর একান্নবর্তী পরিবারের সদস্যদের কাছে। আর শনিবার হলেই তাঁর সবাইকে থ্যাংক ইউ বলে কলকাতার সেই বিখ্যাত মেস এর জীবন ছেড়ে নিজের গ্রামের বাড়ী চলে যাওয়া তাঁর হাসি মুখে। বলতেন সবাইকে চলো সবাই মিলে গ্রামের বাড়িতে পুকুরের মাছ ধরে খাওয়া হবে বেশ আনন্দ হবে। আমার নিজের গ্রামের বাড়ীতে গেলে কোনোও অসুবিধা হবে না একদম।  আর নিজের শরীর ফিট রাখতে এই বয়সেও কেমন করে যে দুশো কপালভাতি করতেন তিনি কে জানে। একদম সবার যখ...

জামালপুরের প্রদীপ দা

আজ আমার সাদা জীবনের কালো কথায় বর্ধমানের জামালপুরের সেই দাপুটে ঠোঁট কাটা সাংবাদিক প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় এর কথা। সেই বিখ্যাত সুভাষ তালুকদার এর কাগজ সংবাদে মাত্র এক টাকার কাগজে কাজ করা সংবাদ পত্রিকার দাপুটে সাংবাদিক সেই প্রদীপ দা। সেই মুখ্যমন্ত্রীর সভায় বাঁশের ব্যারিকেডের এপারে দূরে দাঁড়িয়েও যে খবর করা যায় সেটা বড়ো মিডিয়ার সাংবাদিকদের হাসি মুখে দেখিয়ে দিয়ে, আর তাদের খবরের ময়দানে গোল দিয়ে শুধু খবরকে ভালোবেসে ছোটো কাগজে কাজ করে চলা সর্বদা হাসি মুখের সেই আমাদের প্রদীপ চ্যাটার্জী দা।  কোথাও কোনো অন্যায় দেখলেই প্রতিবাদে মুখর হয়ে যাওয়া আর এক দৌড়ে বেরিয়ে পড়া ঝোলা কাঁধে সেই খবরের খোঁজে সেই জামালপুরের প্রত্যন্ত গ্রামের সেই প্রদীপ দা। সেই বিখ্যাত পন্ডিত রবিশঙ্কর আর উদয়শঙ্কর এর আপন মাসতুত ভাই এর ছেলে সেই প্রদীপ চট্টোপাধ্যায় দাদা। সেই বামদের আমলে জামালপুরের এলাকায় দাপিয়ে খবর করে ছুটে বেড়ানো সেই প্রদীপ দা। সেই তৃণমূল আমলেও একভাবেই ছুটে বেরিয়ে কাজ করা আমাদের সদা ব্যস্ত প্রদীপ দা।  সেই বাবার অসুস্থতার কারনে বড়ো সংবাদ মাধ্যমে কাজ না করেও...

আমার স্যার কাজীদা

সাদা জীবনের কালো কথায় আজ আমার স্যার এর কথা। যার লেখা আজ হঠাৎ চোখে পড়লো একটি কাগজে। আর স্যার এর নামটা দেখেই মনে পড়ে গেলো নানান কথা। হ্যাঁ, সেই কাজী গোলাম গাউস সিদ্দিকী। যাঁর সাথে আমার আলাপ আর দেখা হয়েছিল সেই অজিতদার ফ্রিল্যান্স ছকু খানসামা লেনের ফ্রীল্যান্স প্রেস ক্লাবের অফিসে খুব সম্ভবত। হাসিখুশি বেশ অজাতশত্রু এই মানুষটিকে দেখেই আমার মনে হয়েছিল যে রিপোর্টারদের প্রভূত ক্ষমতা থাকে বোধহয়। তাই পকেটে পেন আর সেই ফোনের ছোট্টো নোটবুক দেখেই আমার মনে হয়, যে ক্ষমতার স্বাদ পাবার জন্য সেই সদ্য গ্র্যাজুয়েশন করে আমার কচি মনে সাংবাদিক হবার বাসনা জাগে সেই সময়।  কোনো প্রাইমারী স্কুলের শিক্ষক নয়, কোনো অফিসে মাছি মারা দশটা পাঁচটার লোয়ার ডিভিশন এর কেরানি নয়, মেডিক্যাল রিপ্রেজেন্টেটিভ নয়, ল্যাবরেটরিতে টেকনিশিয়ান এর কাজ নয়, এল আই সি বা পোষ্ট অফিস এর এজেন্ট নয়, কোনো মুদি দোকানে হিসেব পত্র লেখার কাজ নয়, স্বাধীন ব্যবসা করা নয়। শুধুই সাংবাদিক হবার স্বাদ।  কাগজে সাদা কালো অক্ষরে নিজের নাম ছাপা হবে, সেই নাম দেখে বুক ফুলে যাবে, পাড়ায় প্রতিবেশীরা সহ স...

কুড়ি থালা দশ টাকা আর রসিক মুলুর জীবন

নাম মুলু হাঁসদা। বাংলা ঝাড়খণ্ড সীমানার চরিচা গ্রাম পঞ্চায়েত এর চর ইচ্ছা রঘুবরপুরের বাসিন্দা মুলু। আজ মুলুর জীবন কথা। গ্রামের নামটা ভারী অদ্ভুত। চর ইচ্ছা রঘুবরপুর। যে গ্রাম অন্য পাঁচটা গ্রামের মতই।সাদামাটা এই গ্রামে দারিদ্র্য, অপুষ্টি আর কর্মহীন জীবনের জলছবি সুস্পষ্ট। আর সেই গ্রামের মহিলারা নিজেদের সংসার রক্ষা করতে গাছের পাতাকে আঁকড়ে ধরে রেখেছে। গাছের পাতা মুলুদের জীবনের জিয়ন কাঠি। যে জিয়ন কাঠিতে তারা ভোর হতেই পেটের টানে চলে যায় জঙ্গলে। খস খস শব্দ করে পায় হেঁটে তারা পাতা তোলে। গাছ থেকে টুপ টাপ করে ঝড়ে পড়া পাতাকে একটা একটা করে নিজের শাড়ির আঁচলে ভরে নেয়। তার পর সব পাতাকে বস্তায় ভরে ঘরে ফেরে।  ঠিক যেভাবে তারা পুকুরে নেমে শামুক গেঁড়ি আর গুগলি তোলে। যে ভাবে তাদের উদর পূর্তি হবে বলে। আর এই পাতাও যে তাদের পেট ভরায়। একটা একটা পাতাকে নিজের সন্তানের মতো আলগোছে ছুঁয়ে বুকে জড়িয়ে ধরে চুমু খায় মুলু, বলে তোরা না থাকলে কি করতাম কে জানে। মাথার ওপর শাল সেগুনের বিশাল আকারের গাছগুলো চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে আর তারা চুপ করে শোনে মুলুর কথা।  একে অপ...

শুভ মকর সংক্রান্তি

মকর মানেই নতুন জামা কাক ভোরে স্নান, রাত্রি জেগে মিঠে সুরে টুসুমণির গান। মকর মানেই পিঠে - পুলির গন্ধে ম - ম হাওয়া, ডুলুং পাড়ে টুসুর মেলায় দল বেঁধে যাওয়া। মকর মানেই মোরগ লড়াই পাহুড় জেতার সুখ, সন্ধ্যা - রাতে মাংস পিঠের স্বাদে ভরা মুখ। মকর মানেই হাতি - ঘোড়ার পুজো করম তলে, সান্ধ্য হাওয়ায় মন উদাসী দিমির দিমির বোলে। আসলে আজ এই মকর সংক্রান্তির দিন, টুসু মেলার দিন, টুসু গানে নিজেকে মাতিয়ে দেবার দিন। অজয় এর ধারে জয়দেব কেঁদুলির মেলায় ভীড়ের মাঝে নিজেকে হারিয়ে দেবার দিন। অজয় এর জলে ডুব দিয়ে স্নান করে পূণ্য অর্জনের দিন। আর নদীর ধারে মোরগ লড়াই এর দিন। আকাশে ঘুড়ি ওড়ানোর দিন, সুতো লাটাই হাতে আকাশ পানে তাকিয়ে থাকার দিন। কেমন যেনো রাশির একটি স্থান থেকে অন্য রাশিতে স্থান পরিবর্তনের দিন। সূর্যের দেবতাকে সকালে উঠে স্নান সেরে প্রণাম জানিয়ে শক্তি সঞ্চয় এর দিন। সূর্যের উত্তর দিকে চলে যাবার দিন। ধীরে ধীরে শীতকাল চলে যাওয়ার দিন।  এই মকর সংক্রান্তি এর ইতিহাস ও ভারতীয় ঐতিহ্যের গভীর শিকড় রয়েছে। এটি কৃষি চক্র এবং ফসল কাটার মৌসুমের সাথে জড়িত। এই মকর সংক্রান্তি চ...