লাল সিগন্যালে দাঁড়িয়ে গেছে ট্রেন। স্টেশনের পাশে ফাঁকা আদিগন্ত সবুজ মাঠ। সোনাঝুরি গাছের পাতায় তির তিরে লাজুক কাঁপন। হালকা মিঠে হাওয়ার ঝাপটা আমার গায়ে লাগছে ট্রেনের জানলা দিয়ে। পশ্চিমে তখন ঢলে পড়েছে গনগনে লাল সূর্য। একটু আগেই নদী পেরিয়ে তরতর করে যে ট্রেন হুইশেল দিয়ে এগিয়ে যাচ্ছিল দুদ্দার করে নিজের লক্ষ্যে, সেই ট্রেন এখন স্থবির। এদিক ওদিক সবাই কেমন চুপ করে বসে বা দাঁড়িয়ে প্রতীক্ষা করছে সবাই, কখন ছাড়বে ট্রেন।
আর তার মাঝে ট্রেনের কামরায় বাউল এর ভাব তত্ত্বের গান, মানুষ মরলে বিচার হবে কার। বড়ো সত্যিই কথা বলল যে ওই বাউল। দূরে আদিগন্ত সবুজ মাঠের শেষ প্রান্তে কেমন কালো মেঘের চূড়োয় সূর্যের সোনা রংয়ের আভা ছড়িয়ে পড়ছে চুপি চুপি। ঠিক যেনো ভালবাসার অনুরাগে রঞ্জিত প্রথম প্রেমের ছটা লেগেছে মেঘের চূড়োয় এদিক থেকে ওদিক। ঘরে ফেরা আনমনা পাখির ডানায় সেই লজ্জার লাল আভার মাখামাখি। অনেকক্ষণ হলো আমার যে ট্রেন যেখানে যাবার কথা ছিল সে আর যাচ্ছে না কিছুতেই। ট্রেন থেকে নেমে পড়লাম আমি। স্টেশনের বোর্ডে লেখা নোয়াদার ঢাল। দূরে তাকিয়ে দেখলাম লাল সিগন্যাল জ্বল জ্বল করছে। কিছুতেই সবুজ হচ্ছে না যে।
আচ্ছা যদি এমন করেই আমি এমন চুপটি করে ট্রেন থেকে নেমে পড়তাম কোনো অজানা স্টেশনে। তারপর একা একা হেঁটে নিজের ঘর দুয়ার ছেড়ে হেঁটে হেঁটে চলে যেতাম মেঠো আলপথ ধরে দূরে অনেক দূরে। আমার পথের পাশে আমাকে অনুসরণ করত হলুদ প্রজাপতি কেমন আনন্দে আত্মহারা হয়ে আমায় দেখতো সে। আর ঘরে ফেরা পাখির দল আকাশ থেকে ঘাড় ঘুরিয়ে দেখতো আমায়, আর মনে মনে ভাবতো এই রে আমরা ঘরে ফিরে যাচ্ছি কিন্তু কি হলো রে বাবা ওই লোকটা কি ঘর হারিয়ে ফেলেছে। নাকি এসব কিছুই নয়। নিজেদের মধ্যে আলাপ চারিতায় মেতে উঠতো ওরা।
এমন পরীক্ষা দিতে একদিন এই জীবনে আমার বড় ইচ্ছা করে। যেখানে যাবার তাড়া ছিল সেখানে না গিয়ে এমন নাম না জানা অচেনা পথের পথিক হয়ে ঘুরে বেড়াতে এদিক সেদিক। প্রকৃতির রূপ রস গন্ধ বর্ণ গায়ে মেখে এলোমেলো বাতাসের স্পর্শ নিয়ে বেঁচে থাকতে বড়ো সাধ হয় আমার।
চুপ করে থেমে যাওয়া ট্রেনের লাল সিগনালকে জড়িয়ে ধরে বলতে ইচ্ছা করে না, একদম সবুজ হয়ে যেওনা তুমি এই আমার অনুরোধ তোমায়। অনেক তো সবুজ হয়ে দৌড় এর জন্যে হুইসেল বাজিয়ে বাঁশি বাজিয়ে জীবনের এই মোরাম রাস্তায় দৌড় এর সিগন্যাল দিয়ে এলে জীবনভর। এবার না হয় একটু থেমে যাও তুমি। তোমার সাথে আমিও একটু থামি।
রাস্তায় মেঠো পথ ধরে হাঁটি আমি ঠিকানাহীন ঘরের পানে জোনাকির আলো গায়ে মেখে। যে ঘরে নাম না জানা কেউ অপেক্ষা করছে আমার জন্যে হয়তো। সাঁঝ বেলায় কেমন মাটির পিদিম জ্বেলে সন্ধ্যা দেবে সে। প্রদীপের আলোর আভা তার ঠোঁটে ধাক্কা খাচ্ছে কেমন চুপটি করে। তারপর আলতো ঠোঁটের কোণে এক চিলতে হাসি হেসে আলগোছে কাপড় জড়িয়ে নেবে সে তার বুকের মাঝে। আমি কেমন যেন সেই ট্রেনের মতো স্থবির হয়ে দাঁড়িয়ে রইলাম ওর ঘরের সামনে। সন্ধ্যার নরম আলোয় ওর দু চোখে তখন লজ্জার লাল আভা ঠিকরে পড়ছে। আমিও কেমন বুড়ো হয়েও যে লজ্জায় মাটির পানে তাকিয়ে আছি আমি। সত্যিই তো যদি এমনটা হতো এই দৌড়ে বেড়ানো ছুটে চলা জীবনে। লাল সিগন্যালে আটকে যাওয়া আমার জীবনে এমন হলে কি ভালো যে লাগতো।
দুর থেকে দেখলাম আমার পাশের লাইন দিয়ে আমার ট্রেনের পাশ কাটিয়ে দুদ্দাড় করে নাম না জানা একটি ট্রেন আমায় ফেলে এগিয়ে গেলো দ্রুত গতিতে। দুর থেকে শুনলাম সেই ট্রেনের ইঞ্জিন এর আওয়াজ। আমি দ্রুত গতিতে ফিরতে চাইলাম নিজের ঘরে। সব কিছুকে ফেলে দিয়ে। দ্রুত গতিতে এগোতে থাকলাম আমি। দাঁড়িয়ে পড়া ওই ট্রেনকে আবার ধরবো বলে।
মনে মনে লাল সিগন্যালকে বললাম একটু সময় দাও আমি আসছি। অন্ধকার নামা মাঠের পাশ দিয়ে দ্রুত গতিতে দৌড়তে থাকলাম আমি। আর অবাক হয়ে আমায় দেখলো সেই হলুদ প্রজাপতি। আমাকে অনেক দুর থেকে দেখলো সেই ঘরে ফেরা পাখির দলও। চুপ করে সন্ধ্যা দেওয়া সেই গ্রামের মেঠো রাস্তায় তখন নরম চোখের ওম মাখা হাতছানি। সব কিছুকে ছেড়ে দিয়ে চলে এলাম আমি ট্রেনের কাছে। না, পারলাম না হারিয়ে যেতে।
ট্রেনের কামরায় তখন বাউলের মেঠো সুর, জীবনের কথা আর গান এর মুর্ছনায় মেতে উঠেছে ঘরে ফেরা মানুষের দল কেমন আনন্দে উদ্বেলিত হয়ে। স্থবির ট্রেনের কামরা তখন একটু একটু করে নড়ে চড়ে ওঠার চেষ্টা করছে যেনো। দুরে সেই লাল আলোর গায়ে তখন অন্ধকারের বুক চিরে সবুজের হাতছানি। আমিও দৌড়ে এসে ট্রেনের হাতল ধরলাম। হুইসেল দিলো আমার ট্রেন। সিগন্যাল সবুজ হলো। সব কিছু ফেলে দুলতে দুলতে আমার ট্রেন দুলকি চালে এগিয়ে চলল নিজের গন্তব্যে।
দাঁড়িয়ে পড়া ট্রেন - অভিজিৎ বসু।
ত্রিশ জুলাই, দু হাজার চব্বিশ।
চমৎকার লেখা!
উত্তরমুছুন