সাদা জীবনের কালো কথায় আজ বন্ধুত্বের দিবস পালিত হয়ে যাবার পর আমি আজ লিখতে বসলাম আমাদের সেই দুজনের বন্ধুত্ব নিয়ে কিছু কথা। আসলে বন্ধুত্বের সংজ্ঞা তার ব্যাপ্তি এত বিরাট যে তাকে বোঝাবো কি করে। এটা ভাবতে ভাবতেই যে একটা গোটা দিন কেটে গেল আমার। আসলে জীবনে কে বন্ধু আর কে বন্ধু নয় সেটার ফারাক বুঝতে বুঝতেই যে জীবন ফুরিয়ে যায় আমাদের। কখনও যাকে বন্ধু ভেবে যার দিকে হাত বাড়িয়ে দি আমি কিন্তু পরক্ষণে বুঝতে পারি না ভুল করেছি আমি।
বন্ধুত্বের সংজ্ঞায় এটাই তো বলা আছে যে শ্মশানে, রাজদ্বারে, দুর্ভিক্ষে যে কোনো পরিস্থিতিতে সব জায়গায় তোমার পাশে দাঁড়িয়ে আছে, সাহায্যে করে সেই তো তোমার পরম বন্ধু। পুরান শাস্ত্রে এমন সব কথাই বলা আছে তো মনে হয়। আসলে এসব তো কথার কথা। বন্ধুত্ব দিবসের দিন নিজের ঘর ঝার পোছ করতে বসে আমি কত কিছুই যে ভেবে চলেছি কে জানে। আমি যার কথা আজ লিখতে বসেছি তার সাথে আলাপ আমার সেই কলেজ জীবনে।
আমি তখন সবে কলেজে পা দিয়েছি। কলেজের ম্যাগাজিন তে লেখা বেরিয়েছে একজনের মরার মত বাঁচা লেখক এর নাম ভজন দে। আর সেই লেখকের খোঁজ করতে গিয়েই তো পেলাম শ্রীরামপুর কলেজের সেই রাস্তায় তাকে কাঁধে ব্যাগ নিয়ে ধীর পায়ে এগিয়ে আসছে সে। মরার মত বাঁচা কবিতার লেখককে সেই একঝলক দেখে প্রথম দিন কেমন যেনো একটা ভালো লেগে গেলো আমার।
সেই দুজনের আলাপ আমাদের কলেজের সামনে পূণ্যতোয়া গঙ্গাকে সাক্ষী করেই তো সেদিন হয়েছিল। গঙ্গার ঘোলা জলে তখন নানা জিনিস ভেসে চলেছে। কিন্তু না আজ এত দিন পরেও গঙ্গা দিয়ে অনেক জল বয়ে গেলেও আমাদের সেই সম্পর্ক কিন্তু ভেসে যায়নি আজও। কেমন স্থির হয়ে গেছে দাঁড়িয়ে গেছে চুপটি করে। সেই যৌবনের জোয়ার ভাটার দিন পার করে আজ তো সেই সম্পর্ক এখন পলিপড়া নদীর চড়ার মতই। সে যাক গে সেই কবি ভজন দের কথাই আজ আপনাদের বলব। যার সাথে সেই সুখ দুঃখের স্মৃতির সম্পর্ক আমাদের এখনো রয়ে গেছে এতদিন এত বছর পরেও । যে সম্পর্কের রাস্তায় শ্যাওলা পড়ে পিচ্ছিল হয়ে গিয়ে পিছলে পড়ে যায় নি আমরা দুজনেই এই বুড়ো বয়সেও।
আসলে সম্পর্ক জিনিসটা ঠিক কাঁচের গেলাসের মত। তাকে ঠিক করে দুজনে মিলে বুকে আগলে জড়িয়ে ধরে রাখতে হয় দু হাত দিয়ে। না হলে সে বড়ো অভিমানী যে টুক করে আলগোছে কখন যে ভেঙে যায় কে জানে। কেউ বুঝতেই পারবে না। আর তখন সেই গাছে বসা ঘুঘু পাখির মত গলায় আটকে থাকে দলা দলা দুঃখ, অভিমান আর কষ্ট যাকে গিলে নেওয়া যায় না কিছুতেই। শুধুই দলা দলা যন্ত্রণা সহ্য করে হাসি মুখে বেঁচে থাকতে হয় বাকি জীবন। আসলে সত্যি কারের বন্ধুত্বে যে কোনো স্বার্থ জড়িয়ে নেই। শুধুই নিঃস্বার্থ ভালবাসার গভীর স্পর্শ ছুঁয়ে থাকে। কারণে অকারণে শুধুই সেই ভালবাসার গভীর গোপন বন্ধনে একে অপরকে জড়িয়ে আঁকড়ে ধরে বেঁচে থাকে দুজন দুজনকে জড়িয়ে ধরে।
আজ এতদিন পর দীর্ঘ প্রায় পঁয়ত্রিশ বছর পর জীবনের হাজার চড়াই উৎরাই পার করে আমার এই অভিজ্ঞতা হলো বন্ধুত্ব দিবসের দিনে। ভজন আর আমার সেই বন্ধুত্বের সেই ছোটো চারা গাছের ব্যাপ্তি আজ সেই বটগাছের শিকড় আজ বহুদূর পর্যন্ত ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে এদিক থেকে সেদিক। দুজনের জীবনের ঝড় ঝাপটা সামলে এখনো দিব্যি সেই চারা গাছ বড়ো হয়েও বেঁচে আছে দিব্যি সুখেই। সেই ওদের ছাদের চিলে কোঠার গোপন ঘরে বন্দি হয়ে কেমন করে আজও বেঁচে আছে সেই পুরোনো দিনের সম্পর্ক কে জানে। যেখানে ওর শুধু আমাকে দেওয়া আছে কিছু পাওয়া নেই। আমার তো মাঝে মাঝেই নিজেকে খুব ছোট মনে হয় তবু।
আজ এতদিন পর লিখতে বসে মনে হয় ওদের বাড়ী থেকেই তো প্রতি বৃহস্পতিবার রাতে ওর দেওয়া রেশন এর চাল দিয়ে তো আমাদের প্রতি সপ্তাহের ভাত জোগাড় হতো। কোনো দিন ভুল হতো না সেই কাজে ওর। আসলে ওর মতো দায়িত্ব পালন করা বন্ধু পাওয়া সত্যিই বিরল ঘটনা আজকের দিনে। পুজোর সময় ওর দেওয়া সেই আমার মাকে লাল পাড় শাড়ি কিনে দেওয়া যা আমার আজও মনে পড়লে কেমন যেন মন কেমন করে আমার এই বুড়ো বয়সে এসেও। ওর দোকান বন্ধ করে হিন্দমোটর স্টেশনে সেই রাতের আড্ডা সুখের বাসর বসা, স্টেশনে বসে মশার কামড় খাওয়া , একে একে ট্রেন চলে যাওয়া আর তারপর শেষ ট্রেন ধরে কুকুরের তাড়া খেয়ে বাড়ি ফিরে চালের ব্যাগ রেখে মার বকা শোনা কেমন যেন আমার রোজের ঘটনা ছিল সেই সময়। মনে হয় এই তো সব সেদিন এর ঘটনা এগুলো। বেশিদিন তো হয়নি তাই না।
যেদিন আমি আর ও যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ের সেই প্রবন্ধ লেখা প্রতিযোগিতায় অংশ নিয়ে প্রথম হলাম। ধুতি পড়ে পাঞ্জাবি পড়ে নতুন বরের মত পুরষ্কার আনতে গেলাম সেদিনও যে ওই পাশে ছিল। বলেছিল এমন দিন আরোও আসবে রে। লেখক হয়ে যাবি তুই। না, লেখক হওয়া হয়নি তার বদলে খবরের লোক হয়ে গেলাম আমি। সেই যে আমার জন্মদিনে শুভেচ্ছা বার্তা জানিয়ে রঙিন গন্ধ মাখা চিঠি,আমার প্রিয় লেখক সমরেশ বসুর ছবি দিয়েছিল ভজন। কতদিন যে ছবিটাকে ছোঁয়া হয় নি কে জানে। হয়তো ধুলোর পলেস্তারা পড়ে আছে সেই হাসি মাখা ছবির গায়ে। তবুও আমার আর ওর এই ছোটো জীবনের সম্পর্কে আজও পলেস্তারা পড়ে যায় নি সেই ভাবে কোনো দিন। কেমন করে যে দ্রুত ফুরিয়ে আসা এই ব্যস্ত জীবনেও আমরা এক অপরকে সংসার সামলে বউ এর গাল শুনেও চুপ করে সেই ছায়াঘেরা বন্ধুত্বের সম্পর্ক কে কেমন করে বুকে আগলে রেখেছি কে জানে।
আজ এই বুড়ো বয়সে এসে ওর হাজার শরীর খারাপ এর মাঝে মনে হয় এই পোড়া কপাল এর জীবনে এর থেকে ভালো আর কি হতে পারে বলুন। যেখানে কলেজের গঙ্গা নেই, রাতের অন্ধকারে স্টেশনে ট্রেন এর চলে যাওয়া নেই, ঢাকের বাদ্যি বাজার দিনের সেই মন খারাপ নেই, ঘরে আমার সেই মার বকা খাবার কোনো ভয় নেই, গাছের ডালে বসে থাকা রাতচরা পাখির ডানা ঝাপটানো নেই। এত কিছু নেই এর মাঝেও যে আমাদের দুজনের জং ধরা জীবনে আজও সেই বন্ধুত্ব বেঁচে আছে কেমন করে কে জানে। হয়তো নিজের অজান্তেই মরার মত বাঁচা হয়েই ভজন আর আমার সেই কবেকার বন্ধুত্ব খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে চলছে ক্রাচে ভর করে। এবড়ো খেবড়ো রাস্তায় সে ঠোক্কর খাচ্ছে কোনো রকমে টাল সামলে তবুও সে বেঁচে আছে আমাদের এই ক্ষুদ্র ক্ষয়িষ্ণু জীবনে আজও।
বন্ধুত্বের দিবস পালন হয়ে গেলো। হয়তো কিছুই বলা হলো না আমার। যা বলা হলো না সেই সব কথা না হয় বুকের মাঝেই চাপা থাক। ভালোবাসার জড়োয়া গায়ে জড়িয়ে। আমার বলা হলো না সেই ছোটো বাঁশির কথা, বলা হলো না সেই সাধু দাদার কথা, বলা হলো না ওর মার প্রতিদিন ওদের বাড়ি গেলেই খেতে দেবার কথা, বলা হলো না ওদের সুন্দর জমজমাট বাড়ির কথা, বলা হলো না ওর বোন সোমার কথা। সেই ওর দোকান রামকৃষ্ণ স্টোরে কালীপুজোর সময় বাজি বিক্রির কথা। অনেক কিছুই যে বলা হলো না আমার।
আজ শুধু এটা বলতে পারি সঠিক বন্ধুত্ব হলো অনুভুতির সাগরে ডুব দেওয়া একটা অজানা অচেনা একটা পথের সন্ধান পাওয়া। যার খোঁজ পেলে আর কোনো দিন সেই পথ হারাবার ভয় থাকে না। জীবনের হাজারও ঝড় ঝাপটা সামলে, লেনা-দেনা সামলে বন্ধুর গাল শুনেও সে টিকে থাকে হাসি মুখে। যেমন করে টিকে আছে আমার আর ভজনের সেই বন্ধুত্ব আজও এতদিন পরেও।
বন্ধুত্ব দিবস - অভিজিৎ বসু।
একত্রিশ জুলাই, দু হাজার চব্বিশ।
খুব সুন্দর
উত্তরমুছুন