সাদা জীবনের কালো কথায় আজ এক দোর্দণ্ড প্রতাপ ডাকাবুকো পুলিশ অফিসারের কথা। লালদূর্গ বলে খ্যাত সেই হুগলীর আরামবাগের শহরে গ্রামে, খানাকুলে, গোঘাটে কান পাতলেই আজও যাঁর নাম শোনা যায় ওই যে নন্দা সাহেব তো খুব কড়া পুলিশ অফিসার ছিলেন তিনি। যিনি তাঁর সময়ে বাম আমলের পুর প্রধানকেও আন্দোলন করার জন্য ছাড় দেননি। যদিও পড়ে সেটা আরামবাগ এর তৎকালীন সাংসদের উদ্যোগে মিটে যায়। সেই গল্প অনেকের জানা আছে আজ থেকে প্রায় পঁচিশ বছর আগের গল্প। যা আজকাল এমন ঘটনা হলে কেউ কোনো পুলিশ করতেই পারবেই না।
যাই হোক আসলে কিছু কিছু পুলিশ উর্দি পরেও নিজের কাজ আর নিরপেক্ষতার জোরে আলাদা একটা ব্র্যান্ড তৈরি করেন নিজের কর্মক্ষেত্রে আর তাঁর এলাকায় চারিপাশে। আর সেই ব্র্যান্ড এর জোরেই তিনি মিথ হয়ে যান, ভগবান হয়ে যান। ঠিক তেমনি পুলিশ অফিসার ছিলেন আরামবাগের সেই আমলের বিখ্যাত পুলিশ অফিসার এসডিপিও আরামবাগ অজয় নন্দা। আজ সাদা জীবনের কালো কথায় সেই বিখ্যাত পুলিশ অফিসার নন্দা সাহেবের কিছু কথা। যিনি সাংবাদিকদের বেশি খবর দেওয়ার থেকেও তিনি খবর করাতে খুব বেশি বিশ্বাস করতেন।
যে কোনো উপায়ে তিনি বলতেন একটাই কথা আইন মেনেই কাজ করবেন তিনি। আর বাইরে তিনি কিছুই করতে পারবেন না। আইনের রক্ষক হয়ে এটাই ছিল তাঁর জীবনের ব্রত। আআর তাই বোধহয় রং দেখে তিনি কোনোদিন কাজ করেননি। তিনি মনে করেননি যে শাসক দলের কুনজরে পড়লে তাঁর বদলি হতে পারে যে কোনো জায়গায়। আর তাই সেই কথা হয়তো খুব একান্তে বলতেন তাঁর সেই প্রিয় সাংবাদিক আরেফুল এর কাছে। যাঁর কাছ থেকে নানা খবর পেয়ে টিপস পেয়ে কত যে অপারেশন করেছেন তিনি তার ঠিক নেই। এটাই তো আসল শিরদাঁড়াওলা পুলিশ।
সেই কোনো এক বিকেলে নদী পেরিয়ে খানাকুলের কোনো এক গ্রামে পৌঁছতে হবে। পুলিশের সাথে নৌকায় আমি আর আমার ক্যামেরাম্যান। সালটা দু হাজার সাল বা এক সাল হবে। দড়ি ধরে নৌকো এগিয়ে চলেছে গ্রামের দিকে মানে ডাঙ্গার দিকে। সিপিএম আর তৃণমূলের সংঘর্ষ গুলিবিদ্ধ হয়েছে সিপিএমের সমর্থক। সেই নদীর পাড়ে বহু সিপিএম তৃণমুল সমর্থক ভীড় করে পুলিশের বিরুদ্ধে স্লোগান দিচ্ছে। আমাদের নৌকায় খুব সম্ভবত এসপি গঙ্গেশ্বর সিং, ডিএম ত্রিনাথ সিংহ, আর এসডিপিও ডাকাবুকো অজয় নন্দা।
হঠাৎ করেই তিনি পকেটে হাত দিলেন। জনতাকে ভয় দেখাতে কি শূন্য ফায়ারিং করবেন তিনি। এসপি সাহেবের হাসি মুখে বলা আরে একদম নয়। দেখো না কি হয়। এই হলেন আমাদের নন্দা সাহেব। গ্রামে পৌঁছে গ্রামে টহল দিয়ে ফের ফিরে আসা হলো সেই নৌকো করে একভাবেই দড়ি ধরে। এমন পরিস্থিতি অনুযায়ী যা করতে হবে বস এর আদেশ মেনে সেটাই করলেন তিনি। আসলে সেই লাল আমলের বিখ্যাত সময়েও তিনি যে অনমনীয় মনোভাব দেখিয়ে কাজ করে গেছেন যা পড়ে মা মাটি মানুষের আমলেও করে গেছেন। কোনো বদল হয়নি তাঁর।
হয়তো তার জন্য তাঁর কর্মজীবন চাকরি জীবনে অনেক খেসারত দিতে হয়েছে তাঁকে তবু তিনি কোনোদিন আদর্শের প্রতি বিশ্বাস রেখেই মাথা তুলে কাজ করে গেছেন সারাটা জীবন ধরেই। কোনোভাবেই সমঝোতা করে চলতে পারেন নি তিনি কোনদিন কোনো সময়। আর তারজন্য কোনো সময় দিল্লী চলে গেছেন সেন্ট্রাল এর অধীনে কাজ করতে। আবার কোনো সময় রাজ্যে চলে এসেছেন কাজ করতে। আমি বেশ আজ এত দিন পর এমন একজন অফিসার এর সাথে অল্প কিছু দিন সাংবাদিকতা করে কাজ করার সুযোগ হয়েছিল বলে গর্ব অনুভব করি আমি আজও।
সেই তাঁর চিরচেনা হাসিমুখ। সেই দ্রুত পায়ে হেঁটে যাওয়া। টানটান ঋজু চেহারা। সেই যেবার হিন্দমোটরে স্টেশন এর পাশে মাওবাদীর আস্তানা ধরা পড়লো সেই তাঁর রেল লাইন পার হয়ে ফোর্স নিয়ে বাড়ি ঘিরে ফেলা। সেই নানা চেনা পুলিশ অফিসার দের নিয়ে বিশেষ টিম তৈরি করে মাওবাদী দমনে তাঁকে কাজে লাগানো সরকারের এটা দেখে আমার বেশ ভালো লেগেছিল। সেই আরেফুল বেঁচে থাকলে হয়তো আরও গল্প বলতো। নন্দা সাহেব যে ওকে খুব ভালোবাসত তাকে।
সেই আরেফুল এর ঘর ছেড়ে চলে যাওয়া। আসানসোল এর কোনো জায়গায় রাতে পুলিশের অভিযান করতে যাওয়া নন্দা সাহেবের। আরেফুল তখন ঐ এলাকায় গোপনে থাকে। কেউ কিছুই জানে না। ওর কাছ থেকে খবর পেয়ে সেই অভিযান। যদিও সেটা নন্দা সাহেব জানতেন না এমন কত যে গল্প আরেফুল করতো আমায়। সে সব কথা আজ মনে পড়ে গেলো এই রাতে।
সেই আরামবাগের দোর্দণ্ড প্রতাপ ডাকাবুকো সিপিএমের চেয়ারম্যানকেও যিনি ছেড়ে কথা বলেননি একসময়। পড়ে সেটা মিটমাট হয়ে যায় একটি পুরসভার অনুষ্ঠানে হাজির হয়ে। আজ সেই ডাকাবুকো চেয়ারম্যান কোনও ভাবে আরামবাগ শহরে ক্ষমতা হারিয়ে টিকে আছেন। জীবন তো এমনিই।
কোনো অপারেশনে গিয়ে তিনি দল বিচার করে অ্যাকশন করেননি তিনি। যা মনে হয়েছে সঠিক আর ন্যায় সেটা মেনেই কাজ করেছেন তিনি। আর এটিই যে আজকাল বড়ো অভাব পুলিশের বাহিনীতে। সবাই এখন দলকে মেনে দলকে খুশী করে নেতাকে খুশী করেই কাজ করে চলেছে আর নিজের স্বার্থ রক্ষা করে চলেছে।
আর সেই আজ থেকে প্রায় দীর্ঘ পঁচিশ বছর আগে নন্দা সাহেব এসবের ঊর্ধ্বে থেকেই কেমন হাসি মুখে লাঠি হাতে নিয়ে কাজ করেছেন। আপনি ভালো থাকবেন নন্দা সাহেব। সেই আরেফুল মারা যাওয়ার খবর পেয়ে দিয়েছিলাম। কথা হয়েছিল আমার সাথে অল্প। আজ বহুকাল কথা হয়নি তাঁর সাথে। তিনি কোথায় পোস্টিং সেটাও জানিনা আমি। তবে আজকাল মনে হয় এমন পুলিশ অফিসার এর খুব দরকার। যাঁরা রং দেখে কাজ করবেন না। ভালো থাকবেন আপনি নন্দা সাহেব।
আরামবাগের অজয় নন্দা সাহেব - অভিজিৎ বসু।
তেরো ডিসেম্বর দু হাজার চব্বিশ।
ছবি সৌজন্য গুগল।
মন্তব্যসমূহ
একটি মন্তব্য পোস্ট করুন